একটি দুঃস্বপ্ন!
ড. জাকির হাওলাদার
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলছেন আমি নাকি মারা গেছি! আজকে ২০২০ সালের মে মাসের ২৩ তারিখ। আর দুইদিন পর রোজার ঈদ। আমার লাশের কাছে কেউ আসতেছেনা। এমনকি আমার নিকটাত্মীয়রাও। আসবেইবা কেন? করোনা রোগীর আশেপাশে নাকি ভাইরাস কিলবিল কিলবিল করে। তাই কাছে এসে কেউ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কেন নিবে? আসলে আমি যে মরি নাই একথা কাউকে বলতে পারতেছিনা। আর একটা লোকও আমার কাছে এসে দেখতেছে না যে আমি সত্যি সত্যিই মরে গেছি কিনা।
লাশ কি আবার দেখতে, শুনতে পায়? কিন্তু আমি আজকে চোখে না দেখলেও কানে কিন্তু সবই শুনতেছি। তাইলে আমি লাশ কেন? দূরে দাঁড়িয়ে আমাকে নিয়ে একজন মন্তব্য করছে, “লোকটা ঘাড়ত্যাড়া! এত একটা কঠিন রোগ হওয়ার পরও হাসপাতালে গেলোনা। এখন চাঁদপুরে এই লোকের লাশ কে নিয়ে যাবে?” শুনলাম অন্য একজন বলছে, “পুলিশকে খবর দিলে ভাল হয়। পুলিশই চিন্তা করবে কি করা যায়।” তখন প্রথম ব্যক্তি বললো, “না পুলিশকে খবর দিলে ঝামেলা বাড়বে। আমাদের পুরো এলাকাটাই লকডাউন করে দিবে।
আমি ত্যাড়ামি করে হাসপাতালে যাইনি এটি একটি ডাহামিথ্যে কথা। আমি প্রতিবাদ করতে চাইলাম কিন্তু মুখে আওয়াজ করতে পারতেছিনা।
৭/৮ দিন আগে আমার জ্বর, কাশি, মাথা ব্যাথা শুরু হলে ফোনে এক ডাক্তার বন্ধুর পরামর্শ চাই। সে আমাকে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। চারদিন যাবৎ বউ-বাচ্চাদের থেকে আলাদা থাকতেছি। অনেক অনুরোধ করে এক রিক্সাওয়ালাকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলের উদ্দ্যেশ্যে রওয়ানা হই। মেডিকেলের পূর্বগেইট দিয়ে ঢুকতে যেয়ে বাধা পেলাম। গেইটের সিকিউরিটির একজন বললো,
“ভিতরে করোনা আক্রান্ত রুগীতে তিল ধারণের ঠাই নেই। বারান্দার ফ্লোরেও অনেক করোনা রুগী। এখানে ঢুকলে কষ্ট পাবেন। বরং বাসায় চলে যান, ঠিকমতো ভাল খাবার খান এবং কোন ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ঔষধ খান। ভাল হয়ে যাবেন।”
টনটনে ব্যাথায় মাথা দাড়া করতে পারছিনা। মোবাইলটা হাতে নিয়ে আশেপাশের প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে ফোন করলাম। অধিকাংশই বন্ধ, যে দু’একটা খোলা আছে সেগুলোতে সীট খালি নেই। বাসায় ফিরে এলাম। ডাক্তার বন্ধুকে ফোন করে হাসপাতালে ভর্তি না হতে পারার কথা জানালে সে কিছু ঔষধের নাম বললো এবং বাসায় দৈনিক চারবার নেবুলাইজ করাতে বললো। আবাসিকে আমার বাসার পাশে যে ফার্মেসি থেকে সবসময় ঔষধ কিনি সেখানে গেলাম। সেলসম্যান আবছার বললো, “স্যার এই ঔষধগুলো নাই। কেবল প্যারাসিটামল আর ওরস্যালাইন নিতে পারেন। কয়দিন যাবৎ ঔষধ কোম্পানিগুলোর কোন সাপ্লাই নাই।” রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে বাসার গেইটে ঢুকলাম। জ্বর, মাথাব্যথা ও প্রচন্ড কাশি, গেইট থেকে বাসা পর্যন্ত নিজকে টেনে নিতে পারছিনা। মন চাচ্ছে গেটের কাছেই শুয়ে পড়ি। কোন রকম মে বাসায় ঢুকে দূর থেকে স্ত্রীকে নেবুলাইজ মেশিনটা আমার রুমের সামনে রাখতে বললাম। সে আমাকে বললো, “সকাল থেকে বিদ্যুৎ নাই, নেবুলাইজ মেশিন কি করে চালাবেন?”
সে আরো বললো, আজকে রাতের খাবার চলবে কিন্তু কালকে ভাতের চাল শেষ হয়ে যাবে। মুদি দোকানদারকে ফোন করে বাসায় চালের বস্তা পাঠাতে বলেছিলো কিন্তু দোকানদার বললো আপাতত দোকানে কোন চাল নেই, খাতুনগঞ্জ আড়ৎ থেকে তারা আজকে চাল আনতে পারেনি। আড়তে চাল নেই। নতুন চালান আসলে তারা বাসায় চাল পাঠিয়ে দেবে।
করোনা উপসর্গ দেখা দেয়ার আজকে ৬ষ্ঠ দিন। দুইদিন যাবৎ বাসায় বিদ্যুৎ নেই। শুনলাম অধিকাংশ বিদ্যুৎ স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। ফার্মেসিগুলোতে ঔষধ নেই, মেডিসিন ও মেডিকেল সরঞ্জামে তীব্র সংকট, দোকানগুলোতে তীব্র খাদ্য সংকট, এক সপ্তাহ যাবৎ ইন্টারনেট বন্ধ, ব্যাংকগুলো বন্ধ, কোন লেনদেন হচ্ছেনা, অধিকাংশ প্রাইভেট ক্লিনিক চিকিৎসক সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে। করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত চিকিৎসকরাই। গত দুইমাসে দেশের ৪০% ডাক্তার ও নার্স মারা গেছেন। জনগণের সেবা দিতে গিয়ে প্রশাসনের লোকদের অনেকেই মারা গেছেন। শুনেছি সর্বশেষ ২৪ ঘন্টায় সারাদেশে মারা গেছে ১৭৬৩ জন। কার খবর কে নিবে, পুরো দেশটাই যেনো একটা মৃত্যুপুরী। আমার স্ত্রী বেচারি দুটো ছোট বাচ্চাকে সামলাবে নাকি আমার টেককেয়ার করবে।
কে একজন বলেছিলেন করোনা আক্রান্ত হলে ভেঙ্গে পড়া যাবেনা, সাহস রাখতে হবে। অনেক কষ্টে দরজার কাছে রেখে যাওয়া ভাত-তরকারি টেনে রুমে এনে খাওয়ার চেস্টা করলাম। ২/৪ লোকমা খাওয়ার পর আর সম্ভব হলোনা। বেহুশের মতো পড়ে থাকলাম। গভীর রাতে ঘুম ভাঙলো, নিজকে কিছুটা সুস্থ মনে হলো। মায়ের কথা মনে পড়লো, আমার মেয়ে উমায়রাকে একটু দেখতে মন চাইলো। কিন্তু তাদেরকেতো দেখা সম্ভব নয়। চোখের কোনায় পানির অস্তিত্ব উপলব্ধি করলাম।
সপ্তম দিন। এখন কি রাত না দিন সেটা বুঝার কোন উপায় নেই। কারণ আমি এখন লাশের মতই নির্জীব পড়ে আছি। তবে দূরে দাঁড়ানো লোকদের কথা শুনে মনে হলো এখন দুপুর। শুনলাম একজন বলছেন যে, গ্রামের বাড়িতে লাশ পাঠানো সম্ভব না। আবাসিকের কবরস্থানেও অনুমতি পাওয়া যাবেনা। এখানে প্লটের মালিক ও ভিআইপি মানুষরা দাফনের সুযোগ পায়। দূর থেকে গরম পানি ছিটিয়ে মুর্দা গোসলের কাজ সেরে প্লাস্টিকে পেচিয়ে কোন রকমে শমশেরপাড়া গোরস্থানে দাফন করে ফেলা দরকার। কথামতো গোসল দেওয়ার জন্য দূর থেকে একজন আমার গায়ে গরম পানি ছিটাতে লাগলো। গরম পানিতে নাকি করোনা ভাইরাস মরে যায়।
গায়ে গরম পানির লাগায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমার ছেলে জায়ান আমার গায়ে প্রস্রাব করে দিয়েছে।
(এটি একটি দুঃস্বপ্ন হলেও লকডাউনে সরকারের সিদ্ধান্তগুলো যদি আমরা অমান্য করি, আর্মি ও পুলিশ প্রশাসনের সাথে লুকোচুরি খেলি, বর্তমানে যে হারে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তেছে আল্লাহ না করুক শিঘ্রই আমাদেরকে এই কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।
আসুন আমরা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই এবং যার যার ধর্মানুযায়ী সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমাভিক্ষা চাই।
ভাল থাকুন আপনি। ভাল থাকুক বাংলাদেশ। আমার দুঃস্বপ্ন বাস্তব না হউক।)
কপিরাইট সত্ত্ব-২০২২ ছাত্রছাত্রী ডট কম, কারিগরি সহায়তায়ঃ বিগবস সফট বিডি
স্যর ভাল থাকেন। আল্লাহ আপনাকে দৈর্ঘজীবি করুক।
লিস্টে “ব্যাংক/বীমা’ দুবার এসেছে ভিন্ন ভাবে।