সোনারঙা সকাল। প্রকৃতির চাকচিক্যে মন ও ফুরফুরে! মুগ্ধতার শরৎ শুভ্রতায় মুড়ে এসেছে প্রকৃতিতে। ষড়ঋতুর রঙ্গমঞ্চ এদেশ। এক ঋতু চলে যায়, আরেক ঋতুর আগমনে। শরৎ আসে, যায় ও। শরতের মতোই শুভ্রতায় সাজি কি আমরা!? শরতের মন ভোলানো প্রকৃতিতে মন যে কী চায় তা বোঝা বড়ই মুশকিল। রোদ আর বৃষ্টির লুকোচুরি খেলায় মনে ও জমে ওঠে মেঘ, আবার কখনো রৌদ্রময়।
বারো মাসে ছয় ঋতুর এদেশে ভাদ্র-আশ্বিন মাস জুড়ে প্রভাত রাঙাবে শারদ্ রাজা। এদেশের প্রতিটি ঋতুই বৈচিত্র্যময়। প্রকৃতি কখনো হয় প্রানোচ্ছ্বল চঞ্চল তরুনী, কখনো হয় দীপ্ত সন্ন্যাসিনী, কখনো ক্রন্দনরত অভিমানিনী, কখনো নিষ্প্রাণ জরাগ্রস্থ বৃদ্ধা আবার কখনো বা শান্ত কোমল স্নেহময়ী মাতা।
কবিগুরু শরৎকে বরাবরই দেখেছেন শান্তি, মঙ্গল ও সমৃদ্ধির ঋতু হিসেবে। শরৎ যেন নিয়ে আসে চির তারুন্যের বার্তা। প্রকৃতি সাজে নতুনরূপে। কবি জীবনানন্দের ভাষায়,” যৌবন বিকশিত হয় শরতের আকাশে”। মহাকবি কালিদাসের ভাষায়, “প্রকৃতি এ সময় নববধূর সাজে সজ্জিত হয়ে ওঠে।”
শরৎ মানেই শুভ্র কাশফুল। বিলে শাপলা, গাছে গাছে শিউলির মন মাতানো সুবাসে অনুভূত হয় শরতের ছোঁয়া। পল্লী কবি জসীম উদ্দিন শরৎকে দেখেছেন, “বিরহী নারী” হিসেবে। এ সময় শেফালি, মালতী, কামিনী, জুঁই আর টগর ফুলেরা মাথা উঁচিয়ে জানান দেয় সৌন্দর্য। মিষ্টি সুবাসে চারদিক মোহনীয় হয়ে ওঠে।
গ্রামীণ প্রকৃতিতে শরৎ আসে সাড়ম্বরে। যদিও ইট, পাথরের নগরীতে শরৎ থেকে যায় অনেকটা অন্তরালে। আবার এই শরতেই হয়ে থাকে সনাতন ধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। ঘন কাশবন সাদা ফুলে ফুলে দোল দিয়ে ভরিয়ে তুলে মন প্রাণ। আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা অপরূপ করে তোলে প্রকৃতি। সাদা বকেরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়িয়ে আরো নতুন মাত্রা এনে দেয় এই শরতে।
বর্ষণমুখর দিনের পর বাংলার আকাশে ডানা মেলে আসে এই শুভ্রতার শরৎ। শরৎ মানেই নীল আকাশ আর সাদা কাশফুল। বাঙালির চিরায়ত মনের খাঁটি চিত্র এটা! এসময় ফসলের মাঠে সবুজের ব্যাপক হাসি লেগে থাকে ধানের ডগায় ডগায়। চারদিকে শান্ত-স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় অন্য রকম ভালোলাগা। শরতের এসময় হঠাৎ বৃষ্টির ঝাপটাও বেশ উপভোগ্য। বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতি মনের গহিনে নতুন স্বপ্ন জাগিয়ে তুলে। গুনগুনিয়ে বেজে ওঠে নতুন গান। সুরের আবেশে মন প্রাণ বিগলিত হতে চায়।
শরৎ তার সৌন্দর্য ও শুভ্রতায় অনন্য। তাই একে ঋতুর রাণী ও বলা হয়ে থাকে। ঋতুরাজ বসন্তের যেমন রয়েছে রঙের বা বর্ণের ঐশ্বর্য আর রূপের রাজকীয় অহংকার; ঋতুরাণী শরৎ ও তেমনই সৌম্য, নির্মল সৌন্দর্য আর শান্ত ভাবমূর্তির মূ্র্ত প্রতীক। শারদলক্ষ্মী নামেও একে ধরা হয়। কবিগুরু বলেছেন,
" আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা,
নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা।"
সত্যিই তাই!! বলা যায় শরৎ আসে মানুষের মনের আঙিনায়। দেহ,মন রাঙিয়ে নতুন আবহে শুভ্রময়তায় মগ্ন হতে। কার সাধ্য রোধে!!?
শরতের এ মুগ্ধতা কয়েক বছরের নয়, হাজার-হাজার বছরের! শরতের স্নিগ্ধতাই মুগ্ধ মহাকবি কালিদাস বলে ওঠেছেন,
" প্রিয়তম আমার ঐ চেয়ে দেখ
নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সদ্যস্নাত।"
শরতের শিশির ভেজা সবুজ পথে নানা ফুল ঝরে পড়ে। যা কবির মনে অনাবিল আনন্দের সঞ্চার করে। তাই ভোরের আলোতে কবির হৃদয় হয়ে ওঠে সতেজ ও প্রাণবন্ত। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাই পথিককে শরতের শিউলি বিছানো পথে হাঁটতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন,
"এসো শরত প্রাতের পথিক
এসো শিউলি বিছানো পথে
এসো বুইয়া চরণ শিশিরে
এসো অরুণ কিরণ রথে
দলি শাপলা শালুক শতদলে
এসো রাঙায়ে তোমার পদতলে।"
আমাদের কবিতা, গান, গল্প, সাহিত্যে শরৎ এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। নানা জাতের ফুলের মাঝে মৌমৌ করা সুবাতাস, চারপাশের শুভ্রতার মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা, বৃষ্টিশেষে আবারো রোদ, দিগন্ত জুড়ে সাত রঙা হাসি দিয়ে ফুটে ওঠা রঙধনু!!! এ দৃশ্য শুধু শরতেই চোখে পড়ে।
চর্যাপদের পদকর্তা থেকে শুরু করে আজকের তরুণ কবির রচনায় শরৎকাল তার নান্দনিক ব্যঞ্জনা নিয়ে উদ্ভাসিত। শরৎ যেন জীবনের আরেকটা রূপ!! শেখার আছে অনেক। রোদ- বৃষ্টির এ যৌথ খেলা আমাদের জীবনকেও প্রভাবিত করে৷ সুখ, দুঃখ,আনন্দ-বেদনার এ খেলাঘরে কোনটাকে বুকে আগলে জীবনের পথকে মসৃণ করবো তা আমাদেরই বিবেচ্য!!
সবার সুস্থতা এবং মঙ্গলময় জীবন কামনায়………
সুলতানা কাজী
০৩/০৯/২০২০খ্রিঃ।।
কপিরাইট সত্ত্ব-২০২২ ছাত্রছাত্রী ডট কম, কারিগরি সহায়তায়ঃ বিগবস সফট বিডি
Leave a Reply