স্কাউটিং এর প্রতিষ্ঠাতাঃ জীবন ও কর্ম (প্রথম পর্ব)
অলক চক্রবর্তীঃ চীফ স্কাউট অব দ্যা ওয়ার্ল্ড রবার্ট ব্যাডেন পাওয়েল এর পারিবারিক ডাকনাম স্টিফেন/স্টে। তিনি ২২ ফেব্রুয়ারী ১৮৫৭ লন্ডনের প্যাডিংটনস্থ লোনকাস্টার গেটের স্ট্যানহোপ স্ট্রিটে (বর্তমানে স্ট্যানহোপ টেরেস) মা-বাবার অষ্টম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পিতা প্রফেসর হারবার্ট জর্জেস ব্যাডেন পাওয়েল একজন সম্ভ্রান্ত ধর্মযাজক ও প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন যিনি পেশায় অক্সফোর্ডে জ্যামিতিক শিক্ষক ছিলেন, মা হ্যানরিয়েটা গ্রেস স্মিথ ছিলেন ব্রিটিশ এডমিরালের (রাজকীয় নৌ বাহিনীর কর্মকর্তা) কন্যা। হ্যানরিয়েটা ছিলেন প্রফেসর ব্যাডেন পাওয়েল (বিপির বাবা) এর তৃতীয় স্ত্রী। ১৫ বছরের দাম্পত্য জীবনে নিঃসন্তান অবস্থায় প্রথম স্ত্রী এলিজার মৃত্যুর পর তিনি শার্লট পোপ কে বিয়ে করেন। শার্লটসহ তাঁদের সাত বছরের বৈবাহিক জীবনে তিন মেয়ে ও এক ছেলে রেখে শার্লটও মৃত্যুবরণ করেন। সর্বশেষ হেনরিয়েটার সাথে ১৪ বছরের বৈবাহিক জীবনে তাঁদের ১০ টি সন্তানের জন্ম হয়, যদিও বিপি’র জন্মের আগেই তিনজনের মৃত্যু হয়। বিপির বাবা ছবি আঁকা, লেখালেখি, অর্গান বাজানো পছন্দ করতেন। গণিত, পদার্থ, দর্শন, ডারউইনিজম, ধর্ম ও প্রকৃতির সাথে বিজ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে তিনি নিয়মিত গবেষণা করতেন।
মাত্র তিন বছর বয়সে পিতৃবিয়োগে মায়ের উপর গুরুদায়িত্ব পড়ে চৌদ্দ বছর বয়সের বড়ভাই ওয়ারিংটন থেকে তিনমাস বয়সের ছোটভাই ফ্লেচাসহ পরিবারের সকলের দেখভালের। বহু কষ্টের জীবনেও মা ও ভাইবোনদের ভালোবাসায় বিপির শৈশব আনন্দেই কেটেছে। ভাই বোনদের কাছে হাঁটা ও কথা বলা, মা’র কাছে পড়ালেখা ও প্রার্থনা শেখেন তিনি। আঁকাআঁকি শিখেছেন নিজে নিজে, দু’হাতেই সুন্দর ছবি আঁকতে পারতেন তিনি। ভাইদের সাথে ছোটবেলাতেই হাইকিং, ক্যাম্পিং, ট্রাম্পিং, ক্যানোইং এ বেরুতেন তিনি। ভাইদের সাথে সাগর ভ্রমণের সময় কেবিনবয়ের দায়িত্ব ছিলো বিপি’র, রান্নাও শিখে ফেলেন মা’য়ের কাছে।
বিপি’কে ১০ বছর বয়সে প্রথমে কেনসিংটনের ডেইম স্কুলে, পরের বছর টান ব্রিজ ওয়েলস এর রোজ হিল প্রিপারেটরি স্কুলে এবং তারও দু’বছর পরে (১৩ বছর বয়সে) লন্ডনের চার্টার হাউজ স্কুলে গাউনবয় ফাউন্ডেশনের বৃত্তিপ্রাপ্ত হয়ে ভর্তি করানো হয়। বৃত্তির শর্ত অনুযায়ী সার্ভিসের অংশ হিসেবে বিপি সিনিওরদের গোসলের তোয়ালে এগিয়ে দেয়ার দায়িত্ব পড়ে; এজন্য সিনিওররা বিপি’কে বাথিং টাওয়েল বলেও ডাকত। দুই বছর পর নির্জন ও প্রাকৃতিক পরিবেশে স্কুলের স্থানান্তর হয়। এ সময়ে তিনি ক্যাম্পিং, বোটিং, আর্ট, গান, বাজনা, অভিনয়সহ প্রায় সকল কাজে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তিনি খুবই অনুকরণপ্রিয় ছিলেন এবং বন বাদাড়ে নির্জন পরিবেশে একাকী ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন। তিনি সকল কাজে খুবই কৌতুহলী ছিলেন। ইট বানানো, একইসাথে দু’হাতে আঁকা ও লেখা, যে কোন আবহাওয়ায় গভীর রাতে অল্প আগুনে দ্রুত রান্না করে খাওয়া, কম্পাস ব্যবহার করে ম্যাপ আঁকা, দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশে টিকে থাকা ইত্যাদি ছিলো তাঁর কৌতুহলের ফল ও নিয়মিত অভ্যাস।
উনিশ বছর বয়সে ১৮৭৬ সনে তিনি চার্টার হাউজ থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে পারিবারের আগ্রহে অক্সফোর্ডে ভর্তির বদলে বিশ্ব ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন। হঠাৎ সেনাবাহিনীর অফিসার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখে তাতে অংশগ্রহণ করেন। ৭০০ প্রার্থীর মধ্যে চতুর্থ হওয়ায় তখনকার নিয়মানুযায়ী তিনি প্রথম ছয় জনের মধ্যে থাকায় সামরিক একাডেমির প্রশিক্ষণ ছাড়াই সরাসরি সাব লেফটেন্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাঁকে ভারতের লক্ষ্মৌ এ অবস্থানরত থার্টিন হুসার্স রেজিমেন্টে পদায়ন করা কয়। কঠোর দক্ষতা ও অধ্যবসায় এর প্রমাণ দিয়ে তিনি দ্রুতই পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন।
এ সময়ে তিনি সামরিক কাজের পাশাপাশি লেখালেখি, কুকুর ও অশ্ব পালন ও প্রশিক্ষণ দেয়া, শুটিং, তথ্যানুসন্ধান, গুপ্তচরবৃত্তি, ম্যাপ তৈরি ও পাঠোদ্ধার নাটকে অভিনয়, পোলো খেলা, শ্যুটিং, ভ্রমণ ইত্যাদি করতেন। মার্চ করে দেড়মাসে ৯০০ মাইল পরিভ্রমণ করে মথুরায় আয়োজিত সর্বভারতীয় পিগস্টিকিং এ অংশ নিয়ে আকর্ষণীয় কাদির পদক জিতে নেন তিনি। যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ হিসেবে তিনি ২৬ বছর বয়সে ক্যাপ্টেন এবং ৪৩ বছর বয়সে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন। সময়ানুবর্তি, চৌকস, অন্ধ ভিক্ষুক সেজে শত্রু শিবিরে প্রবেশ, যুদ্ধের ম্যাপ তৈরি, সাইন ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার, বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা শিখে তা কাজে লাগিয়ে তথ্য নেয়া, নিজস্ব কৌশল ব্যবহার করে অচেনা পথে চলা, ছদ্মবেশ ধারণ ইত্যাদি কাজে কর্মক্ষেত্রে তাঁর বেশ সুনাম ছিলো।
তিনি সদালাপী, হাসিখুশি, ফুর্তিবাজ ও বিনয়ী ছিলেন। তাঁর জীবনে তাঁর বড়ভাই জর্জ এর যথেষ্ট প্রভাব ছিলো। গোপন প্রতিবেদনের কাজে তিনি আফ্রিকা থেকে জার্মানি ও রাশিয়াও ভ্রমণ করেন। আফ্রিকার দুর্ধর্ষ জুলু সম্প্রদায়ের সাথে যুদ্ধে তিনি বেশ নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন। মাল্টায় দায়িত্ব পালনকালে ইতালিসহ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে তিনি গোয়েন্দাবৃত্তিতে নিয়োজিত ছিলেন যা তিনি নিজের লেখা “My Adventures as a spy” এ বর্ণনা করেছেন। তিনি স্কাউটিং ও পাইওনিয়ারিং (মূল বাহিনীর অগ্রগামী অংশ যা দুর্গম এলাকায় মূল বাহিনীর প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করে) বাহিনীর দায়িত্বও পালন করেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার আশান্তিতে থাকাকালে তিনি কাউবয় ক্যাপ পরা, বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরুপ বাঁ হাতে করমর্দন, অধীনস্থদের বিভিন্ন অদ্ভুত নামে ডাকা ইত্যাদি কাজে আকৃষ্ট ও অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, ট্র্যাকিং এর আশ্চার্যজনক দক্ষতার জন্য স্থানীয়রা বিপি’কে ইমপিসা (দ্যা উলফ দ্যাট নেভার স্লিপ) নামে ডাকতো। মাতাবেলিল্যন্ডে থাকাকালে তিনি শত্রুর ফাঁদে পা দিয়েও স্বীয় বুদ্ধিতে বেঁচে যান তিনি। আফ্রিকার জুলু সম্প্রদায়ের প্রধান ‘দিনি জুলু’র কন্ঠহার ও বিখ্যাত বিজয়স্মারক ‘কুদু হর্ণ’ হস্তগত করেন তিনি। আফ্রিকাস্থ ম্যাফেকিং এ বুওর যুদ্ধে তিনি জেনারেল পিয়েত ক্রনজি বাহিনী দ্বারা ২১৭ দিন অবরুদ্ধ থাকেন এবং অনেক কৌশল ব্যবহার করে মুক্ত হন। এ যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বের জন্য রাণী ভিক্টোরিয়া তাঁকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে কম বয়সী জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি প্রদান করেন।
১৯০১ সনে রাণী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড বিপি’কে সিবি উপাধিতে ভূষিত করেন এবং একই বছর তিনি সাউথ আফ্রিকান ওআর মেডেল লাভ করেন। ১৯০৭ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন। অবসরের কিছুদিন আগে তাঁকে নিউ টেরিটোরিয়াল আর্মির নর্দাম্ব্রিয়ান ডিভিশনের উচ্চতর দায়িত্ব প্রদান করা হয়। বিপির আকাশছোঁয়া ব্যাক্তিগত জনপ্রিয়তার কারনে তাঁর লেখা ‘এইডস টু দ্যা স্কাউটিং’ পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে এবং ইংল্যান্ডের স্কুলগুলোতে পাঠ্য বইয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯০৭ সালের ১-৯ আগস্ট গ্রীষ্মে ইংলিশ চ্যানেল পুল হারবারের ব্রাউন সী দ্বীপে ২০ জন বালক নিয়ে প্রথম পরীক্ষামূলক ক্যাম্প আয়োজন করেন বিপি। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির বালকদের নিয়ে এ ক্যাম্পে ৫ জন করে এক একটি দলে বিভক্ত করে নিজস্ব দলনেতার অধীনে কাজ করতে দেয়া হয় যা স্কাউটিং এ প্যাট্রোল সিস্টেম নামে পরিচিত। ১৯০৮ সনের ২২ আগস্ট থেকে ০৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাক্সহ্যাম এর হামশ্যাগ এ রেজিস্টার্ড স্কাউট দলের ৩৬ জন স্কাউট নিয়ে দ্বিতীয় স্কাউট ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এবং পরবর্তীতে নিজের প্রতিষ্ঠিত গিলওয়েল পার্কের লিডার প্রশিক্ষণ কোর্সে কুদু হর্ণ ব্যবহার করেন তিনি। ১৯২৯ সালে অ্যারো পার্কের জাম্বুরিতে শেষবারের মতো কুদু হর্ণ বাজান তিনি।
১৮৮৪ সনে বিপির লেখা প্রথম বই “Reconnyaisance and Scouting” এবং ১৮৮৯ সনে দ্বিতীয় বই “Pigsticking or hoghunting” প্রকাশিত হয়। ১৯০৮ সনের জানুয়ারি থেকে ১৫ দিন পরপর ৬ খন্ডে তাঁর লেখা স্কাউটিং ফর বয়েজ বই প্রকাশিত হয়। ১৯০৯ সালে গণনায় দেখা যায় শুধু ইংল্যান্ডেই ৮০,০০০ স্কাউট রয়েছে। ধীরে ধীরে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের বাইরে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে স্কাউটিং।
১৯১০ সালের ৭ মে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড এর সম্মতি নিয়ে ৫৩ বছর বয়সে ৩৪ বছর সার্ভিসশেষে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন বিপি। এর পরই তিনি দুটো,লস্কাউট প্যাট্রোল নিয়ে স্কাউটিং এর ভ্রাতৃত্ব ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর করেন।
১৯০৯ সালে ক্রিস্টাল প্যালেসে স্কাউট র্যালি অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ১১,০০০ স্কাউটের সাথে সাতজন মেয়ে স্কাউটও অংশগ্রহণ করে। ১৯১১ সালে উইন্ডসর প্যালেসের আরেকটি র্যালিতে প্রায় ৩০,০০০ স্কাউট অংশগ্রহণ করে যেখানে ইংল্যান্ডের নতুন রাজা পঞ্চম জর্জ আনুষ্ঠানিকভাবে র্যালি পরিদর্শন করেন। (চলবে)
লেখকঃ অলক চক্রবর্তী, উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ স্কাউটস।
কপিরাইট সত্ত্ব-২০২২ ছাত্রছাত্রী ডট কম, কারিগরি সহায়তায়ঃ বিগবস সফট বিডি
Leave a Reply